থ্রি ইন ওয়ান

1392746361_shakoor majid.jpg


তার ছবির সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক আগের। তবে তাকে আমি চিনতাম না। সে সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা ছিলো দৈনিক বাংলা। সাদা-কালোর যুগ। আমি ছিলাম ওই পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। কারণ খেলাধুলোর খবরগুলো ভালো করে ছাপা হতো ওই পত্রিকায়। তাই বলে কোন পৃষ্ঠাই চোখের দৃষ্টির বাইরে থাকতো না। ভেতরের পাতায় মাঝে মাঝেই ছাপা হতো তার তোলা শৈল্পিক ছবি। চলমান ঘটনা, কিন্তু উপাস্থপনায় ছিলো আলাদা বৈশিষ্ট্য। ক্যামেরার লেন্স আর মাথার চিন্তার অপূর্ব সমন্বয় ঘটাতে তার কোন জুরি ছিলো না। আমি তখনই তার কীর্তির ভক্ত। দেখতাম আর অবাক হতাম- কি করো প্রকৃতিকে এতো চমৎকারভাবে ছবির ফ্রেমে আটকে ফেলা যায়! হ্যাঁ, এই তিনি আর কেউ নন, আমাদের সবার প্রিয় শাকুর মজিদ।
এখনো স্মৃতিতে উজ্জল তার তোলা রমনা পার্কের একটি ছবি। গাছের ফাকঁ গলে সুর্যের আলো ঝিলিক মারছে ইট আর ঘাসের রাস্তায়। সবুজ গাছের ফাকঁ দিয়ে ঝিলিক দেয়া সুর্যের রশ্মি আমাকেও যেন কল্পনায় টেনে নিয়ে যায় ঘটনাস্থলে। বলাআবশ্যক, ছোটবেলা থেকে আমারো ছবি তোলার ঝোঁক ছিলো। কল্পনায় আমার হাতও ক্যামেরার শার্টারে ঘুরপাক খেতো। কিন্তু আমার দামী ক্যামেরা ছিলো না। ছিলো একটা অটো ক্যামেরা। তাই ভালো কোন ছবি দেখলেই গবেষণায় বসতাম- কি করে এটি হলো? শাকুর মজিদ ছিলেন সে সময় আমার অনুপ্রেরণা। অচেনা, অদেখা সেই মানুষটি আমার ছোট্ট হৃদয়ে সে সময়েই ঠাই করে নিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে ছবির নিচে ক্যাপশনের পর তার নাম দেখে হৃদয়ের ফ্রেমে বয়েসের হিসাব কষতে বসতাম- আচ্ছা শাকুর মজিদের বয়েস কতো? দেখতেই বা কেমন? রাগ করবেন না, তখন কেন জানি শাদা চুলের এক বয়স্ক ব্যক্তির প্রতিচ্ছবিই আমার সামনে ভেসে উঠতো শাকুর মজিদের কল্পনায়।
তবে এ কৌতুহল মেটাতে অপেক্ষা করতে হলো আরো কিছুটা সময়।
সালটা ছিলো ১৯৯২। সে সময়ের আলোচিত সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী ইত্তেফাক ছেড়ে দিয়ে আজকের কাগজ পত্রিকার হাল ধরলেন। রীতিমতো হই চই ফেলে দেয়ার মত্ইো ছিলো খবরটি। সে সময় ইত্তেফাকের মতো পত্রিকার লোভনীয় চাকরি ছাড়ার কথা কেউ কল্পনাও করতেন  না । কিন্তু মতিউর রহমান চৌধুরী করেছিলেন। কিন্তু আজকের কাগজে বেশি দিন থাকতে পারেন নি। হঠাৎ করেই তাকে সেখানকার পাঠ চুকাতে হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই কিছু করবেন। বাংলাবাজার পত্রিকার অনুমোদনও পেলেন। গ্রীনরোডের অফিসে আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে শুরু করলো। ওই সময়ের প্রতিভাধরদের বেশিরভাগই নতুন একটি পত্রিকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এক ছাদের নীচে জড়ো হলেন। আজকের কাগজ ছেড়ে আমরাতো মতিউর রহমান চৌধুরীর সেনিকদলের অগ্রভাগে। সেখানেই একদিন পরিচয় শাকুর মজিদের সঙ্গে।
আমার তো তখন ভিড়মি খাওয়ার উপক্রম। কোথায় ভাবতাম বুড়ো আলোকচিত্রী। কিন্তু আমার স্বপ্নের ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী যে তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সব সময় সঙ্গী তার একটি ক্যামেরার ব্যাগ। বাংলাবাজার পত্রিকায় তিনি কাজ করতেন সেন্ট্রাল ডেস্কে। টেলিপ্রিন্টারে কট কট শব্দ করে যে সব বার্তা আসতো, টেবিলে বসে শান্ত সুবোধ বালকের মতো সেগুলো অনুবাদ করাই ছিলো তার কাজ। নিরলসভাবে তিনি করেছেন এটি। এর বাইরে বোনাস- ক্যামেরা নিয়ে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া। তারপর ছবির ঘটনা নিয়ে লেখা। থ্রি-ইন ওয়ান। এখন  তিনি কতোর ভেতর কতো- সে পরিসংখ্যান করা কষ্টকর। আমরা স্থপতি শাকুর মজিদকে নাট্যকার, নির্মাতা হিসেবেও পেয়েছি।
ফিরে যাই শুধু বাংলাবাজার পত্রিকার স্মৃতিতেই। সত্যিই অন্যরকম সেই দিনগুলো ছিলো। আমরা প্রত্যেকেই ছিলাম বয়েসে তরুণ। নেতৃত্বে যারা ছিলেন একটু বয়স্ক, তারাও চেতনায় ছিলেন তরুণ।  সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিলো, আমরা কেউ এক কাজে সšত্তষ্ট থাকতে পারতাম না। ্একটি শেষ করে অন্যটি করতে পারলে নিজেকে বেশি ধন্য মনে হতো। ওই সময় আমরা সবাই দিন-রাত লিখতাম। আমি ছিলাম রিপোর্টার। পথে-ঘাটে ঘোরাই আমার কাজ ছিলো। তাই বলে ডেস্কের  কাজ করতে পারবো না- সেটা নয়। আমাদের ওপর কোন বিধিনিষেধ তো ছিলোই না। বরং বাড়তি কাজের জন্যে আমরা প্রশংসিত হতাম। শাকুর মজিদও প্রশংসিত হতেন। কারণ ডেস্কেও বাইরে তিনি শুধু ছবিই তুলতেন না, সেটি নিয়ে লিখতেনও। আমরা প্রত্যেকেই সাংবাদিকতাকে দারুণভাবে উপভোগ করেছি। সে সময় আমরা সারা জাগানো একটি সিরিজ করেছিলাম। এর নাম ছিলো রাতের ঢাকা।  যদিও সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর কাছে এর প্রস্তাবক ছিলাম আমিই। কলকাতার তিনশ’ বছর নিয়ে এর অনেক আগে সানন্দা একটি প্রচ্ছদ রিপোর্ট করেছিলো- রাতের কলকাতা। খুব মনযোগ দিয়ে পড়েছিলাম। সে সময়ই মনে হয়েছিলো- রাতের কলকাতা হলে রাতের ঢাকা হতে পারবে না কেন? সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করার সময় সারা রাত ধরে পেস্টিং হতো। রাতের ঢাকা নিয়ে রিপোর্টেও ওয়ার্ম আপ করেছি অনেক দিন ধরে। একদিন হঠাৎ এক বন্ধু জানালো, সে সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রা এমন একটি আইডিয়া নিয়ে প্রচ্ছদ রিপোর্ট করার কথা ভাবছে।
বলা দরকার, ওই সময় পত্রিকাগুলোর ভেতরে দারুণ প্রতিযোগিতা ছিলো। এক পত্রিকার কারণে আরেক পত্রিকার প্রচ্ছদ রির্প্টো কতোবার যে বদল করতে হয়েছে। দৈনিক পত্রিকায়ও তখন দেখেছি, প্রধান শিরোণাম কিংবা প্রধান রিপোর্টের বিষয়টি গোপন রাখা হতো। বন্ধুর কথায় স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়ার উপক্রম। তাই তাড়াতাড়ি করেই  রাতের ঢাকা’র আইডিয়াটা সম্পাদককে জানালাম। বললাম, এখনই এটি না করলে পুরনো হয়ে যাবে।
সঙ্গে সঙ্গে শুধু আইডিয়াটা ্পাসই হলো না, নির্দেশও চলে এলো- শুরু করুন এবং আজ থেকেই। ফ্রন্ট ফুটেই ব্যাট চালালেন বাংলাবাজার পত্রিকার ওই সময়কার বার্তা সম্পাদক হিফজুর রহমান্রও। বললেন, আমিও যাবো। উৎসাহ উদ্দীপনা চারদিকে। রিপোর্টিং আর ডেস্ক বলে কোন কথা নেই। প্রথম দিন রাতের ঢাকার অভিযানে এক সঙ্গে ময়দানে এক ডজন সংবাদকর্মী। এ রকম একটা সুযোগের অপেক্ষায় সব সময়ই বসে থাকতেন শাকুর মজিদ। কাজেই ক্যামেরা নিয়ে তিনিই এগিয়ে গেলেন সামনে।
মজার এক আবিষ্কারের ঘটনা প্রথম রাতেই। স্টেডিয়াম এলাকার এক যাত্রী ছাউনিতে হাজারো ছিন্নমুল মানুষের মাঝে ঘুমিয়ে ছিলো হারিয়ে যাওয়া, ঘর পালানো এক কিশোর। মাঝরাতে আমরা সবাই তাকে নিয়ে ছুটলাম তার বাড়ির দিকে। খিলগাঁও তালতলা রিয়াজবাগে বাসা তার। প্রিয়জন হারানো বাড়ির কারো চোখেই ঘুম নেই। কেউ তসবিহ জপ করছিলেন। কেউ বা জায়নামাজ নিয়ে প্রার্থনায়। আমরা ডজন সাংবাদিক যখন মাঝরাতে হারিয়ে যাওয়া কিশোরটিকে বাড়িতে পৌছে দিলাম, তখন সে  এক অভাবনীয় দৃশ্য। আনন্দের কান্না বাড়ি জুড়ে। অভিনন্দন আমাদেও সবাইকে। প্রথম দিনের অভাবনীয় এ ঘটনায় আমরাও উজ্জীবিত দারুন। আমরা তো শুধু স্বাক্ষী। চোখে দেখলাম। আর কলমে নোট করলাম। শাকুর মজিদের কাছে আছে ঘটনার প্রমান।  ক্যামেরা যে তার সঙ্গেই ছিলো।
বাংলাবাজার পত্রিকায় সে সময়ের বহুল আলোচিত সিরিজ রাতের ঢাকা’র অনেক প্রমান এখনো রয়ে গেছে শাকুর মজিদের কাছেই। যদিও রাতের ঢাকার অভিযানে দ্বিতীয় দিন থেকেই আমাদের টিম ছোট হতে শুরু করে। ফজলুল বারী, কাওসার মাহমুদ আর আমি শেষ পর্যন্ত এটি চালিয়ে নিয়ে গেলেও শাকুর মজিদ অনেক দিন ক্যামেরা নিয়ে নিঃসঙ্গ রাতে আমাদের প্রেরণা যোগান। আহ­ কতো ঘটনাই ঘটেছে ওই সময়ে।
একদিন  গভীররাতে আমরা হাজির মিটফোর্ড হাসপাতালে। মাঝ কিংবা শেষ রাতে হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন থাকে- আমাদের উদ্দেশ্য সেটিই দেখার। আর এ অনুসন্ধানে আমরা পেলাম হাসপাতাল লাগোয়া এক ভবনের বারান্দায় বেশ ক’জন যৌনকর্মীকে। তাদের সুখ দু:খের কাহিনীর অনুসন্ধান করতে গিয়ে পেলাম পুরুষবেশী এক তরুণীকে। মাস্তান আর সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে জীবন আর ইজ্জত রক্ষায় সে পুরুষের পোশাকে নিজেকে ঢেকে রাখে সারাদিন। রিকশাও চালায়। কেউ বুঝতে পারে না। তাদের কাছে বিশ্বস্ত হতে আমরা বারান্দার ফ্লোরে বসেই  খুব ঘনিষ্ঠভাবে ওই কাহিনী শুনছিলাম। শাকুর মজিদ হঠাৎ দাড়িয়ে ক্যামেরার লেন্সে পুরো ঘটনাটি বন্দি করে ফেলেন।
তখন অবশ্য ডিজিটাল ক্যামেরার যুগ ছিলো না। শাকুর মজিদ সে দিন তার ক্যামেরায় কি ধারন  করেছিলেন, জানা হয় নি আজো। তবে যখনই এ নিয়ে প্রশ্ন করি, তার উত্তর- একদিন যখন বিখ্যাত হবে, তখনই বের করবো ক্যামেরার এ ইতিহাস- যৌণকর্মীদেও সঙ্গে মাঝরাতে আড্ডা দিচ্ছো? জানি শাকুর মজিদের কাছে ইতিহাসের কোন শেষ নেই। যেখানেই হাত দেন, সাফল্য তার সেখানে। এতো সাফল্যের ভিড়ে দুই যুগ আগের সে স্মৃতি কি আর খুজে বের করা যাবে? তবুও কেন জানি মনে হয়, শাকুর মজিদ সেই স্মৃতি হাতড়াতে যাবেনই যাবেন। কারণ, পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে বাংলাবাজার পত্রিকার দিনগুলো নিঃসন্দেহেই তার জন্যে একটি ইতিহাস। আর আমাদের গর্ব- ওই সময়টা বিখ্যাত এই ব্যক্তির সঙ্গে আমরা কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। স্মৃতির অ্যালবামে আমাদের সঞ্চয়ও কম নয়। কেবল সেটি আছে হৃদয়ে, কাগজে-কলমে। আর শাকুর মজিদের কাছে জীবন্ত, ক্যামেরায়। আমাদের চেয়ে তিনি তাই এগিয়ে। তার স্মৃতির ভান্ডার সমৃদ্ধ হাজারো প্রমানে।

ইলেকট্রনিক পত্রিকা সব সম্ভব যেখানে

একটি  দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশের জন্যে কতটা স্থানের প্রয়োজন- এমন প্রশ্নে নিঃসন্দেহেই পাল্টা প্রশ্ন হবে আরেকটি। সেটি ...