জীবনের দ্বিতীয় লেখা

1505723288_Kb2 (2).jpg

আনন্দটা যেন গুপ্তধন পাওয়ার মতোই। অবশেষে খুঁজে পেলাম নিউজপ্রিন্টে, ছাপার অক্ষরে জীবনের দ্বিতীয় লেখাটি। গর্বে বুক ফুলে উঠার মতো বিষয়টা হলো, পত্রিকার পৃষ্ঠায় ওই লেখার অলঙ্করণ করেছিলেন দেশের তারকা শিল্পী আফজাল হোসেন । ‘ছেলেটি’ - আমার জীবনের দ্বিতীয় লেখার শিরোণাম। কিশোরবাংলার মুদ্রিত তারিখটি জানিয়ে দিচ্ছে, এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ১০ জানুয়ারি । আমি তখন স্কুলের শেষ ক্লাশের শিক্ষার্থী। স্পষ্ট মনে আছে, স্কুলের রাফ খাতায় প্রথম লিখেছিলাম লেখাটি। তারপর কাটাকুটি করে সাদা কাগজে ভালো করে লিখে একটা অনুরোধের চিঠিসহ পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কিশোরবাংলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রফিকুল হক দাদুভাইয়ের ঠিকানায় । অপেক্ষা শুরু এরপর থেকেই। প্রতি সপ্তাহের পত্রিকায় চোখ বুলাতাম। একের পর এক পৃষ্ঠায় তন্ন তন্ন করে খুঁজতাম। পড়তাম প্রীতি নিও বিভাগের সবগুলো চিঠি। প্রীতি নিও বিভাগ ছিলো দাদু ভাইয়ের সঙ্গে কিশোরবাংলার বন্ধুদের যোগাযোগের বিভাগ। কার লেখা মনোনীত হলো, কারটি ছাপানো গেলো না থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও দাদু ভাই লিখতেন। আমি বুকে আশা নিয়েই দেখতাম, আর ভাবতাম- আমার লেখাটি পেলে দাদু ভাই নিশ্চয়ই এখানে তার মতামত জানাবেন।কিন্ত্ত দুর্ভাগ্য, দাদু ভাই প্রীতি নিও’তে আমাকে নিয়ে কিছুই লিখলেন না। তবে, অবাক হয়েই পত্রিকার পৃষ্ঠায় একদিন আমি আমার লেখাটি আবিষ্কার করলাম। বাসায় থাকা রাফ খাতাটি মিলিয়ে দেখলাম। না, ঠিকইতো আছে।যা লিখেছি, তা-ই তো ছাপা হয়েছে হু বু হু। দ্বিতীয় লেখায় আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেলো, বোধ হয় পারবো। ‘আমাদের লেখা’ বিভাগের দ্বিতীয় লেখা ছিলো এটি। বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই ছাপা হয়েছিলো। যদিও লেখক হিসেবে আমার নামের বানানটি ছাপা হয়েছিল ভুল। ‘শহিদুল’ হয়ে গিয়েছিল ‘শহীদুল’ । এ নিয়ে আমার খানিকটা মনোকষ্ট ছিলো। সেই মনোকষ্ট দ্রুতই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো,যখন জানতে পারলাম, আমার লেখার সঙ্গে লাল রঙ্গে আকাঁ যে চিত্রটি সংযোজন করা হয়েছে, এর শিল্পী দেশসেরা টিভি তারকা আফজাল হোসেন। দেশে তখন টিভি ছিলো একটিই, বিটিভি । আর বিটিভি নাটকে সেরা পারফরমার ছিলেন আফজাল । এখনকার অভিনেতা অভিনেত্রীদের মতো হরহামেশা তার নাটক দেখার সুযোগ ছিলো না। তাই আফজাল - সূবর্ণার নাটক প্রচারের ঘোষণা এলে  চারদিকে হুলস্থুল পড়ে যেতো। সন্ধ্যার পর সবাই রেডি হয়ে বসতো টিভি সেটের সামনে। বয়েস কম হলেও, আমিও ছিলাম সেই দর্শকদের একজন। কাজেই চিত্রশিল্পী হলেও অভিনেতা আফজাল ছিলেন আমারও স্বপ্নের নায়ক। মতিঝিলের অবজারভার ভবনে চিত্রালী লাগোয়া ছিলো কিশোরবাংলার অফিস। সেখানে আমার যাতায়াত ছিলো। যুগান্তরের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম, পিআইবির মহাপরিচালক শাহ আলমগীর ভাই তখন কিশোরবাংলার নিজস্ব সংবাদকর্মী। প্রতি সপ্তাহেই নামে বেনামে তারা লিখতেন। তাদের পাশেই বসতেন চিকন চাকন গড়নের আফজাল হোসেন। তিনি কিশোর বাংলার প্রচ্ছদ আর ভেতরের পৃষ্ঠাগুলোতে অলঙ্করণ করতেন। রফিকুল হক দাদু ভাইয়ের রুমে যাওয়া আসার সময় আড় চোখে তার টেবিলের দিকে তাকাতাম। মাঝে মাঝে তাকে সেখানে পেতাম। কখনো বা নয়। তাকে দেখতে পেলে এলাকায় ফিরে বন্ধুদের কাছে নানা গল্প ফাঁদতাম। বৃহস্পতিবার দাদু ভাই ‘প্রীতি নিও’ লিখতেন। এদিন একের পর এক চিঠি খুলে পড়তে গিয়ে ভীষন ব্যস্ত সময় কাটাতেন দাদু ভাই । এক বৃহস্পতিবার তার টেবিলের সামনে গেলে দাদু ভাই রীতিমতো রেগেই উঠেছিলেন আমার ওপর। কখনই বৃহস্পতিবার অফিসে আসবে না- গলাটা উঁচু করেই জানিয়ে দিয়েছিলেন । আর লেখা কবে ছাপা হবে প্রশ্ন করে আরেকদিন সাইফুল আলম ভাইয়ের কি যে ধমক খেয়েছিলাম। কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, লেখা দেয়ার কাজ তোমার, দিয়ে দাও। কবে যাবে প্রশ্ন করবে না। সে সময় লেখালেখি করতে জানেন, হেনো কোনো ব্যক্তি নেই যারা কিশোর বাংলায় যেতেন না। সম্মানীর জন্যে নয়, সম্মান আর ক্ষুদে পাঠকদের ভালোবাসা পেতেই তারা কিশোর বাংলায় ছুটে যেতেন। আমার বড় ভাই কিশোর বাংলায় লিখতেন। তার উৎসাহেই কিশোর বাংলা চিনি আমিও। কিশোর বাংলার পর বড় ভাই আর এ পথে না এলেও এটিই আমার পেশা, রুটি রুজির মাধ্যম হয়ে গেলো। সে যাই হোক, আমার লেখা ছাপার হওয়ার পর আমার প্রথম কাজ হলো এলাকায় ঘুরে ঘুরে খোঁজ নেয়া, কে কে কিশোরবাংলা রাখে । এরপর সবাইকে বলে দিলাম পত্রিকা বিক্রির আগে যেনো আমার ছাপা হওয়া লেখাটি আমাকে দেয়া হয়। আর দ্বিতীয় কাজ টি ছিলো বাসায় কেউ এলেই তার সামনে হাজির হতাম পত্রিকার পাতাটি নিয়ে। কেউ কেউ আগ্রহ নিয়ে পড়তেন। সমালোচনা করতেন। উৎসাহ দিতেন। কেউ কেউ ব্যস্ততার অজুহাতে কয়েক লাইন পড়েই ভালো হয়েছে বলে সান্তনা দিতেন। ‘ছেলেটি’-ছাপা হওয়া অনেক কাগজ আমি জমিয়েছিলাম। দু:খের হলেও সত্যি, সেগুলো এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। আমার অগোচরে বাসার কেউ সের ধরে বিক্রি করে দিয়েছে। অথবা নস্ট হয়ে গেছে। একদিন দাদু ভাইয়ের সাথে কথা হলো, জানাতে চাইলাম- কোথায় পাওয়া যেতে পারে কিশোরবাংলার পুরনো সংখ্যাগুলো ? তিনি বলতে পারলেন না। একই প্রশ্ন নিয়ে দ্বারস্থ হলাম আরও অনেকের কাছে ।একই উত্তর সবার কাছ থেকেই । শেষে নিজেই লাইব্রেরি থেকে লাইব্রেরিতে ঢু মারতে শুরু করলাম। বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিতে কিশোরবাংলার কয়েকটি কপি পেলাম। খুঁজে পেলাম বড় ভাইয়ের বেশ কটি লেখা। সবশেষে জাতীয় গ্রন্থাগারে হাজির হলাম। সাময়িক সদস্য হয়ে অনুসন্ধানে পেলাম কিশোরবাংলার একটিই ফাইল। যেখানে ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত সময়ের হাতে গোনা মাত্র কটি পত্রিকা আছে। ৭৯-এর ঈদসংখ্যায় ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল দীপু নাম্বার টু উপন্যাস লিখেছিলেন। সেই উপন্যাস নিয়ে তখন আমাদের ভেতরে কী উত্তেজনাই না ছিলো । পুরনো সেই পত্রিকার পাতায় হাত দিতেই ফিরে গেলাম শৈশবে। পরম মমতায় একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতেই চোখের সামনে হাজির হলো আমার লেখাটি। খুশিতে আমার শরীর যেন অবশ হয়ে গেলো। আহ্, এতো আনন্দ! ৩৩ বছর আগে কি লিখেছিলাম, এটি আদৌ লেখা হয়েছিল কী না এ প্রশ্ন এখন একেবারেই গৌণ। শুধু বুঝছি, কিশোরবাংলায় প্রকাশিত এ লেখাটি আমার কাছে অমূল্য সম্পদ। আমার ভিত্তি। আমার প্রেরণার উৎস।

ছেলেটি

১৯৮৩ সালের ১০ ডিসেম্বর কিশোরবাংলায় প্রকাশিত ফিচার। এটি আমার জীবনের দ্বিতীয় লেখা।  এর অলঙ্করণ করেছেন আফজাল ...