সাগরময় ঘোষের সেই সাক্ষাৎ
স্মৃতি রোমন্থনে আছে আলাদা একটা শিহরণ । পেছনের দিনগুলো কি কেবলই দীর্ঘশ্বাসের? না। তা নয়। যতো কষ্টের জীবনই হোক। তাতে সুখ স্মৃতিও কম নয়। তৃপ্তি পাওয়ার মতো আছে কতই না ঘটনা। এর চেয়েও বড়- পেছনের দিনগুলোতে নানা আচরণে ছিলো বোকামীপনা- ভাবলে নিজের মনেই লজ্জা লাগে। আবার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ঘটনাগুলো শরীরের অলস পেশীগুলোকে শক্ত করে দেয়। কখনো বা স্মৃতিগুলো অশ্রু ঝরায়। সে কারণেই জীবনের সঙ্গী স্মৃতি। সুযোগ পেলেই স্মৃতির রাজ্যে ডুবে যাওয়ার হাতছানি। অবসর জীবনে স্মৃতিটাই হয়ে যায় বেচেঁ থাকার বড় এক অবলম্বন। কেবলই যে নিজের স্মৃতি হাতড়াতে পরম আনন্দ- তা নয়। অন্যের স্মৃতিতেও খুঁজে পাওয়া যায় নিজের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর নানা দৃশ্যপট। আর সে কারণেই হয়তো কর্মজীবন শেষে অবসরে কম বেশি সবাই কলম খুলে বসতে চান স্মৃতিচারণে। তবে সে সময় কি আসলে স্মৃতি হৃদয়ে উজ্জল থাকে? ইত্তেফাকের সিনিয়র সাংবাদিক জিয়াউল হক ভাইয়ের বক্তব্য, স্মৃতির ঘটনাগুলো তাৎক্ষনিকভাবে লিখে ফেলাই ভালো। কারণ তাতে বিকৃতি এড়ানো সম্ভব। দিন যতো যায় স্মৃতি বিস্মৃতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সংবাদপত্র জগতে শুরুর দিনগুলোর প্রতিদিনই আলাদা শিহরণ অনুভব করতাম। স্বপ্নের জগতের বাসিন্দা। কল্পনায় প্রতি মুহূর্তেই উপস্থিত -এডভেঞ্চার। কাজ শেষে যখন ছুটি পেতাম, বন্ধু-বান্ধব আর সিনিয়রদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনময় করেই সময় কাটতো। সে সময় হৃদয়ে দাগ কাটতে পারে কিংবা শ্রোতার মনযোগ আকর্ষণ করতে পারে- এমন কথাই বলতাম। বর্ণনা শেষে তাই শ্রোতার কাছ থেকে পাওয়া যেতো ধন্যবাদ। পরামর্শও। আমার তরতাজা স্মৃতির শুনতে শুনতে একদিন তাই জিয়াউল হক ভাই বললেন, সময় থাকতে স্মৃতি কথা লেখা উচিৎ। পেশাগত জীবনের ২৩টি বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু স্মৃতিকথা লেখার সুযোগ হলো না। এরপরও কিছু কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে হৃদয়কে নাড়া দেয়। মনে হয় ঘটনাগুলো একেবারেই সাম্প্রতিক। জীবন্ত।
ঘটনাটা ৮৯ সালের সেপ্টেম্বরের। সংবাদপত্র জগতে তখন আমার হাটি হাটি পা পা। ছাত্রত্ব শেষ হয় নি। তবে সাপ্তাহিকের জগতে দাপুটে বিচরণ। ফি মাসে বেতন আসছে পকেটে। সংসার চালানোর কোন দায় নেই। পকেটের পয়সায় ঢাকার বিভিন্ন রেস্তোঁরার কাবাব পরোটা খাবার সুযোগ- কে ছাড়তে চায়। তাছাড়া বাবা-মা ছিলেন বেশ উদার। পড়ালেখার সময়শেষে স্বাধীনতা ছিলো ভালো কিছুতে জাড়িয়ে থাকার। তারা ভেবেছিলেন, লেখালেখি তো খারাপ কিছু নয়। লিখতে হলে পড়তেও হবে। আর পড়াশোনায় ডুবে থাকলে পাঠ্যবই খুব একটা কঠিন হবে না। তবে তাদের ধারণাটা খুব একটা সঠিক হয়তো ছিলো না। সংবাদপত্রে লেখালেখির মজাই আলাদা। পাঠ্যবই পানসে। একঘেয়ে। একথা বলতেই হবে সংবাদপত্র জগতে আমার শুরুর সময়টা তরুণদের জন্যে এখনকার মতো অবারিত ছিলো না। পত্রিকায় সে সময় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সংবাদকর্মীর কদরই ছিলো বেশি। যারা সারাক্ষণই পড়াশোনায় ডুবে থাকতেন। এক হাতে সিগারেট, আরেক হাতে চায়ের কাপ। নিউজপ্রিন্টের ওপর তারা এমনভাবে কলম চালাতেন যেগুলো ছাপার অক্ষরে একেকটা স্বর্ণাক্ষরে রূপ নিতো। এরপরও অনেকের জীবনে অনেক বিস্বাদের ঘটনা ছিলো। এ পেশা নিয়ে তাদের অনেক দীর্ঘশ্বাস ছিলো। তাই তাদের মুখে মাঝে মাঝেই হতাশার কথা উচ্চারণ হতো। অনেকেই চাইতেন না আমরাও হতাশার সে পথে যাই। তাই লেখালেখি নিয়ে বেশি মাতামাতি করতে চাইলে অনেকে মুখ ভার করে পরামর্শ দিতেন- উহু, এখন সে সময় নয়। আগে লেখাপড়াটা শেষ করে আসো। শফিক রেহমানের সাপ্তাহিক যায় যায় দিন এবং মিনার মাহমুদের বিচিন্তা সে সময়ের সংবাদপত্র জগতের আলোড়ন। পেশাদার সাংবাদিকরাই ছিলেন যায় যায় দিনের লেখিয়ে। এরশাদ সরকারের আমলে এ সাপ্তাহিক বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর বিচিন্তা নতুন ঝড় তোলে। একদল আনকোরা তরুণ সংবাদকর্মীকে নিয়েই মিনার মাহমুদ নতুন লড়াইয়ে নামেন। আর তখনই তরুণদের সম্পর্কে ধারণা পাল্টাতে থাকে সংবাদপত্র মালিক থেকে শুরু নীতি নির্ধারকদের। এর আগে আমরা যারা সংবাদপত্রজগতে জায়গা করে নেয়ার জন্যে ফাঁক ফোকর খুজছিলাম, বিচিন্তার পর আমাদের কাজটা সহজ হয়ে যায়। ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের স্নেহে লাবণীতে নিয়মিত লেখার সুযোগ হয় কলেজে পড়ার সময়। যদিও লেখালেখির হাতে খড়ি ৭৯’তে কিশোর বাংলায়। লাবণীতে স্পোর্টস সামলাতেন আরেক ছড়াকার আশরাফুল আলম পিন্টু। লুৎফর রহমান রিটন চাকরি ছেড়ে দিলে তার জায়গায় চলে যান পিন্টু। স্পোর্টস বিভাগ খালি হয়ে যায়। লাবণীর সম্পাদক ফয়জুল কবিরের দুরবীনে ধরা পড়ি আমি। একদিন তার কক্ষে ডাাক পড়ে আমার। সরাসরি প্রস্তাব- স্পোর্টস লিখবে নাকি রেগুলার?
আমি মাথা ঝাঁকাই- না। এখন যা লিখছি, সাধারণ বিষয়ে লিখতে চাই।
তিনি লোভ দেখান, লাভ হবে কিন্তু স্পোর্টস লিখলে।
কি লাভ?
স্টেডিয়ামে ঢোকার একটা সিজন টিকিট পাবে। প্রতি সপ্তাহে বিদেশী পত্রিকা কিনে দেয়া হবে। পড়তে পারবে। আর মাঝ শেষে চারশ’ টাকাও পাবে নিয়মিত।
খেলাধুলোপ্রেমী হিসেবে সে সময় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে আমি অনেকটাই নিয়মিত দর্শক। খুব কষ্ট হতো গ্যালারির টিকিটের পয়সা জোগাড় করা। মাঝে মাঝে খেলাপ্রেমী বড় ভাই বা কোন আত্মীয় বাড়িতে এলেই হলো, আকুতি জানাতাম মাঠে নিয়ে চলুন না। এ সব অনুরোধে ভালো কাজ হতো। ফয়জুল কবির ভাইয়ের প্রস্তাবটি তাই মনে ধরেছিলো। ভালোই তো আর কোন বড় ভাই কিংবা খেলাপ্রেমীর জন্যে বাড়িতে অপেক্ষা করতে হবে না। সে সময় মোহামেডান আবাহনীর খেলায় নিয়মিত মারামারি হতো। পুলিশের লাঠিচার্র্জ, টিয়ারগ্যাস ছোড়ার ঘটনাও ঘটতো । পত্রিকায় বড় করে এ সব খবর প্রকাশ হতো বলে পরিবার থেকে সব খেলায় মাঠে যাওয়ার অনুমতি ছিলো না। সে সুযোগটা নিতেই ফয়জুল কবির ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। লাবণীর লেখালেখিতে কামাল লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে নগরীতে বেতনভিত্তিক সাংবাদিক হিসেবে অভিষেক হয়। তিনি অবশ্য ওই পত্রিকায় বেশি দিন ছিলেন না। বাংলারবাণী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মীর নুরুল ইসলাম পত্রিকার নগরীর হাল ধরেন। আমিও তার সহযোগী হয়ে এ জগতে স্থায়ী হতে শুরু করি। এভাবেই পালাবদলে একদিন নাম লেখাই সন্দ্বীপে। আলোচিত আরেকটি সাপ্তাহিক। বলা যায় এ সময়েই সাংবাদিক হওয়ার এডভেঞ্চারের নেশায় ডুবতে শুরু করি। দেশসেরা সাংবাদিকরাই কলাম লিখতেন সন্দ্বীপে। খ্যাতিমানদের অনেকের বিচরণও ছিলো ওই পত্রিকাটিতে। তাদের স্নেহ আর মমতায় রঙিন স্বপ্নগুলোর জানালা খুলছিলো একের পর এক। সাক্ষাৎকার নেয়ার ছুতোয় দেশের নামকরা সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পীদের আর্শীবাদ গ্রহণের মিশন শুরু আমার। সেটি ইন্টারনেটের যুগ ছিলো না। ঢাকার নির্দিষ্ট কিছু স্থানে বিদেশী বিশেষ করে ভারতীয় পত্রিকা বিক্রি হতো। এর মধ্যে দেশ ছিলো অন্যতম। শিল্প- সাহিত্য নিয়ে যাদের মাতামাতি, দেশ নিয়ে তাদের মধ্যে রীতিমতো কাড়াকাড়ি লেগে যেতো। দেশের একটি সংখ্যা নিজের করে পেতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হতো। বড়দের অনেকেই বলতেন, দেশ না পড়লে ভাষা শেখা যাবে না। সাংবাদিকও হওয়া যাবে না। দেশ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সাগরময় ঘোষ। আড্ডার টেবিলে প্রসঙ্গক্রমেই উঠে আসতো তার কীর্তি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়ের পেছনে তার কি অবদান সে কথাও ছাপিয়ে যেতো ঔপন্যাসিক আবুল বাশারের প্রসঙ্গ এলে। সাগরময় ঘোষই তো কলকাতার সাহিত্যে আবুল বাশারকে উপহার দিয়েছেন। প্রতি সংখ্যায় উপহার দিচ্ছেন একের পর এক নবীন লেখক। এ সব কাহিনী শোনার পর সাগরময় ঘোষের আর্শীবাদ পেতে খুব ইচ্ছে করতো। ভাবতাম তার স্পর্শ পাওয়া গেলে হয়তো সামনে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র পাওয়া যাবে। কিন্ত কিভাবে সাগরময় ঘোষের সান্নিধ্য পাওয়া যাবে?
একেবারেই সহজ বিষয়। চলে যাও কলকাতা। তার পর সোজা প্রফুল্ল চন্দ্র স্ট্রিট। সেখান থেকে বেরোয় কলকাতার সবচেয়ে প্রভাবশালী আনন্দবাজার পত্রিকা। দেশ-এর অফিসও সেখানে। চেষ্ঠা করে দেখো। ভাগ্যগুনে পেয়ে যেতো পারো সাগরময় ঘোষকে- হ্যাঁ এভাবেই সিনিয়ররা বুকে স্বপ্নের আচর দিয়ে দিতেন।
এমনিতেই বুদ এডভেঞ্চারের নেশায়। এর ওপর স্বপ্নের হাতছানি। ঠিক করে ফেলি যে করেই হোক সাগরময় ঘোষের আর্শীবাদ পেতেই হবে। কিন্তু পাসপোর্টই নেই। কলকাতা যাবো কি করে। সন্দ্বীপের নির্বাহী সম্পাদক সালেম সুলেরী অনুপ্রেরনা দিলেন- চিন্তার কিছু নেই। তুমি ফরম জমা দাও। বাকিটুকু আমি দেখবো। তিনি দেখেছিলেনও। খুব দ্রুতই পেয়ে গিয়েছিলাম পাসপোর্ট। এসবি অফিস আর পাসপোর্ট বিভাগ জীবনের প্রথম পাসপোর্ট পেতে আমাকে দারুনভাবে সহায়তা করেছিলো। এরপর ভিসার লাইনে। সেটিও হয়ে গেলো বিনা বাধায়। উত্তেজনার ব্যরোমিটারে পারদ তখন তুঙ্গে। রাতগুলো নির্ঘুম হতে শুরু করলো। স্বপ্নে কলকাতা দেখছি প্রতিদিনই। হিন্দি শব্দ কানে বাজছে। কলকাতা সম্বন্ধে জ্ঞান নিতে যে সব পত্রিকা ম্যাগাজিন পড়েছিলাম, এর স্থির ছবিগুলো স্বপ্নে জীবন্ত, চলমান হয়ে ওঠলো। পকেট সমৃদ্ধ ছিলো না। তাই জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমন সড়ক পথে। ঢাকা থেকে যশোর কোচ সার্ভিসের টিকিট কিনি। তর সইছিলো না- কবে কখন বাস ছাড়বে। এলো সে আকাক্সিক্ষত দিন। আমি একা নই। আমাদের পত্রিকার সিনিয়র আলোকচিত্রী ফরিদ বাশারও আমার সঙ্গী। সাহস। রাতে ছেড়ে যায় দুরপাল্লার বাস। নির্দিষ্ট দিনে গাবতলী টার্মিনালে পৌছাতেই দুঃসংবাদ পেলাম। বলা হলো, আজ কোন বাস টার্মিনাল ছেড়ে যাবে না। কেন?
ধর্মঘট।
ফরিদ বাশার বললেন, চলুন বাড়ি ফিরে যাই। ধর্মঘট শেষ হলে না হয় আবার রওনা হবো।
আমি বললাম- না। আজই কলকাতা যাবো। বাড়ি ফিরে গেলে এই সফর শেষ এখানেই। সাংবাদিকতার এডভেঞ্চারের নেশা পেয়ে বসেছে আমাকে। আমি বললাম, ভ্রমনের মজা তো এটাই। কঠিন পথ না মারালে এডভেঞ্চার হবে কিভাবে।
ফরিদ বাশার বললেন, আমার তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু সবাই নিষেধ করছে। বলছে,ধর্মঘটে শুধু চলে মালিক সমিতির বাস। রাতের ফাঁকা রাস্তায় ভয়ের অনেক কিছুই আছে।
আমি অনড়। বললাম, বাসা থেকে বেরিয়েছি। গেলে আজই যাবো। নইলে না। অগত্যা রাজি হতেই হলো ফরিদ বাশারকে। আমার পিড়াপিড়িতে ভিড় ঠেলে তিনি টিকিট নিয়ে এলেন। কাউন্টারে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সহায়তাও চাইলেন। কাজ হলো- আমরা নির্দিষ্ট সিট পেলাম। রিপোর্টের নানা বিষয় ডালপালা মেলতে শুরু করলো এরপরই। পুরো টার্মিনালের যাত্রীদের স্ত্রোত যেন এ বাস ঘিরেই। একাধিকযাত্রীর হাতে একটি সিটের নম্বর। তিনি বলেন- এই সিট আমার। আরেকজন বাধা দেয়- না। এটা আমার। কেউ চিৎকার করে- কই বাসের কনডাকটর? আমার সিট কোনটা। কে বাসের কনডাকটর এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দেয় না। শুরু হয় ধমকা ধমকি। কারো কারো টিকিট নিয়ে বাসের লোকজন পরীক্ষা করার নামে উধাও হয়ে যায়। হট্টগোলে কান জ্বালাপালা। ততক্ষণে বাসের ছাদ উপচে পড়েছে যাত্রীতে। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি ছাদটা ভেঙে পড়বে মাথার ওপর। কত মানুষ বাসের ভেতর। বাড়ি ফেরার তাড়া।
হই হট্টগোলের মধ্যেই এক সময় বাস চলা শুরু করলো হেলে দুলে। বাসের ভেতরে কোথাও তিল পরিমাণ জায়গাও খালি ছিলো না। হাতল ধরে দাঁড়িয়ে মানুষ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কি যশোর যাবেন? কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞাসাও করলাম দু একজনকে। তারা হাতের টিকিট দেখিয়ে বললেন, ওরা তো সিটই বিক্রি করেছে। এখন বলছে উল্টো কথা। টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে মার খাওয়ার অবস্থা হয়েছে। এর চেয়ে এভাবে যাওয়াই বা খারাপ কি। কষ্ট কিছু হবে। বাড়ি তো ফিরতে পারবো। লোকগুলোর জন্যে মায়াই হলো।
বাস চলতে শুরু করতে না করতেই অন্যরকম অবস্থা। সবার ঘুমে ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ গুলো বন্ধ হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে নাক ডাকার শব্দে কেঁেপ ওঠে বাসটা। কি অবাক করা বিষয়, দাড়িয়ে দাড়িয়ে কেউ ঘুমাতে পারে নাকি?
দেখলাম এক হাতে হাতল ধরে মাথা কাত করে নাক ডাক ডাকছেন অনেকেই। কেবল ঘুম নেই চালক , হেলপার আর আমার চোখে। স্টিয়ারিং ধরে রাস্তার সামনের দিকে দৃষ্টি চালকের। মাঝে মাঝে কি যেন কথা বলছে হেলপারের সঙ্গে। আর আমি চোখের পাতা না ফেলে বার বার পরখ করছি পুরো বাস। অজানা আশঙ্কা আমার দুচোখের পাতা এক করতে দিচ্ছে না।
একটানেই মানিকগঞ্জ পর্যন্ত পৌছলো বাস। এরপর আরিচা। ফেরিতেও ওঠলো। ততক্ষণ পর্যন্ত বাসের ভেতরের সব বাতি নেভা। ফেরিতে ওঠার পরই জলে ওঠলো বাতিগুলো। তখনই চিৎকার- অজ্ঞান হয়ে গেছে এক যাত্রী। নাক ডাকা বন্ধ। সবার দৃষ্টি পেছনের দিকে। দু’সিটের আসনে মাথা কাত করে পড়ে আছেন এক যাত্রী। এই পানি দাও, বাতাস করো। চিৎকার যাত্রীদের। চালকের আসনে নিরুদ্বিগ্ন তিনি। রেকর্ডারে একটি ক্যাসেট লাগিয়ে দিলেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই সংজ্ঞা ফিরলো ওই যাত্রীর। এরপরই হাউ মাউ করে কান্না। আমার পকেটের টাকা কই?
কতো টাকা?
সাতশ’টাকা।
কি খেয়েছিলেন- পান। পাশের যাত্রীর কাছ থেকে।
সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেন ক’জন- অপরিচিত লোকের কাছ থেকে খাবেন না কিছু। এবার চালককে জিজ্ঞাসা- একজন প্যাসেঞ্জার কিভাবে কোথায় নেমে গেলো? বাস চালক নির্বিকার। যাত্রীরা যখন প্রতিবাদী হতে চাইলেন তখনই ক’জন বাসে ওঠলো। বাস কর্তৃপক্ষের লোকই হবে। রাগত স্বরেই তাদের জিজ্ঞাসা- যে বেশি হই চই করবে, যমুনায় ফেলে দেয়া হবে। মাঝরাতে নিকষ কালো অন্ধকার। যমুনার ওপর দিয়ে ছুটছে ফেরি। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান খান ফেরির আওয়াজে। আমার কৌতুহলী চোখ খুজছে বাসের হেলপারকে। গাবতলী থেকে যে এসেছিলো- এখন সে কোথায়? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না। বাস ফেরিতে ওঠার সময়ই কি সে নেমে গেছে। আমি তো সারা রাত জেগেছিলাম। তাহলে তার নেমে পড়ার দৃশ্য আমার চোখে ধরা পড়লো না কেন? নাকি অন্য সবার মতো আমিও তন্দ্রচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম?
যমুনা পাড়ি দিয়ে বাস আবার ছুটছিলো। গাছ-গাছালি ঘেরা অন্ধকার পথ। দরজায় দাড়ানো হেলপার। না। তাকে তো আগে দেখি নি। যাত্রীকে অজ্ঞান করার সঙ্গে কি বাসের হেলপারের কোন যোগ সাজশ ছিলো? এর সঙ্গে চালকও জড়িত? তা না হলে যাত্রী সেবায় সে এগিয়ে না এসে ক্যাসেটে গান বাজাতে উদ্যোগী হলো কেন?
বুঝলাম সতর্ক হতে হবে। রহস্য উদঘাটন করতে হবেই। বাকি পথটাতে অন্যমনস্ক হওয়া যাবে না মোটেও। বাস ছুটছে হেলে দুলে। মাথার ওপর চাদঁও ছুটছে। নাক ডাকার শব্দে আবারও ভারী হয়ে ওঠলো বাসের ভেতরটা। তখন রাত ২টা। অন্ধকার পথ। হঠাৎ ব্রেক কষার শব্দ। থেমে গেলো বাস। সবার চিৎকার- কি হলো, কি হলো? সামনে চোখ রাখতেই দেখা গেলো চালকের আসন ফাকাঁ। অ্যাই ড্রাইভার গেলো কোথায়?
উত্তর এলো অনেকক্ষন পর- প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছে। ক’জন যাত্রী বললেন, এখানে কেন? আরে এখানে ডাকাতের ভয় আছে। আমার মেরুদণ্ড দিয়ে তখন শীতল অনুভূতি। বাস চালক ডাকাত দলের সদস্য না তো?
শিগগিরই ফিরলেন বাস চালক। স্বস্তি ফিরে এলো। বাসের চাকা ঘুরতে শুরু করলো। আবারও নাক ডাকার শব্দ। আমি তখনো জেগে। হঠাৎ চোখ পড়লো বাস চালকের পেছনের আসনে। এক পুরুষ যাত্রীর সঙ্গে খুনসুটি করছে এক মহিলা যাত্রী। গাবতলীতে যখন বাস ছাড়ে নি তখন তাকে পেছনের সিটে দেখেছিলাম। বাসে ওঠেই তিনি জানান দিয়েছিলেন, তার স্বামী চাকরি করেন যশোরে। সপ্তাহের ছুটির দিনের আগে তিনি স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যান। এই পুরুষযাত্রী কি তার পরিচিত? গভীর রাত পেরিয়ে যাচ্ছে। পুবের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। কামারখালী ফেরি ঘাটে যখন পৌছালো বাস, তখন একেবারেই ভোর। একটার পর একটা ট্র্রাক নেমে আসছে ফেরী থেকে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাসের সব যাত্রী। এমনকি মহিলার পাশে বসা ওই পুরুষযাত্রীটিও। কেবল জেগে মহিলা যাত্রীটি। ফেরি থেকে নামা ক’জন ট্রাকচালকের সঙ্গে জানালা দিয়ে কুশল বিনিময় করলেন মহিলা। ট্রাকচালকদের সঙ্গে তার সম্পর্কের রহস্য নিয়ে প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করে আমার মাথার ভেতর।
এখনও মনে পড়ে সকাল ৭টার মধ্যেই যশোরে পৌছায় আমাদের বহন করা বাসটি। হাফ ছেড়ে বাচিঁ। বাস টার্মিনাল ফাকা। এখান থেকে মিনবাসে যেতে হবে বেনাপোল। মিনিবাস পাওয়া গেলো... অ্যাই বেনাপোল বেনাপোল ডাকছে হেলপার। ঘুমকাতুরে কিছু বাসযাত্রী মিনিবাসে ওঠেই ঘুমিয়ে পড়লেন। যাত্রীর অপেক্ষায় মিনিবাস। যেই মিনিবাস ছাড়ার উদ্যোগ, ওমনি ধরফর করে সেখানে হাজির বাসের সেই মহিলা। সঙ্গে বাসের হেলপারও। সারারাত খুনসুটি করেছেন যে পুরুষ যাত্রীর সঙ্গে, তাকে উদ্দেশ্য করে একেবারে শুদ্ধ ভাষায় বললেন, দেখুন রাতে বাসে আপনার পাশে বসেছিলাম। আমার কাছে কিছু টাকা ছিলো । পাচ্ছি না।
পুরুষ যাত্রীটি বললেন, আপনি কি বলতে চাইছেন?
এবার হেলপার রাগত স্বরে বললো, কি আর বলবে, ব্যাটা টাকা দে...।
পুরুষ বাসযাত্রীর চোখ চরকগাছ। বাসের হেলপার ততক্ষণে পৌছেঁ গেছে ওই যাত্রীর কাছে। পুরুষ যাত্রীটি বলছেন, আপনি পাশে বসেছেন। কিন্তু আমি তো আপনার টাকা নিতে যাবো কেন? তার কথায় মহিলা কিংবা হেলপারের কান দিলেন না। চড়াও হলেন। ঠিক সে সময়ে আমি দাড়িয়ে চিৎকার করে বললাম, সাবধান। ওঁর গায়ে হাত দেবেন না। আমি সাংবাদিক। সারারাত বাসে কি হয়েছে, আমি সব দেখেছি। ড্রাইভার বাস ছাড়–ন। সামনের থানায় নিয়ে যান। এরপর কে দোষী কে দোষী নয় তা খুঁেজ দেখবো। মিনিবাসে ঘুমন্ত মানুষগুলো আড়মোড়া ভেঙ্গে ওঠলেন। তারা আমাকেই সমর্থন দিলেন। বললেন, ড্রাইভার বাস চালাও। থানায় যাও...। হেলপার আর ওই মহিলা দ্রুত নেমে পড়লেন।
নির্ঘুম রাতের পর ক্লান্তি চোখে মুখে। বিরক্তিকর ঘটনাও কম ঘটে নি। কলকাতায় গেলেই বোধ হয় রক্ষা। বেনাপোল সীমান্তে ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কর্ম সম্পন্ন হয়ে গেলো খুব দ্রুত। সংবাদকর্মীরা বরাবর এসব জায়গায় বাড়তি সুবিধা পায়। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা নোম্যান্স ল্যান্ড পর্যন্ত আমাদের এগিয়েও দিয়ে এলেন। এরপরই ভারতে ঢোকার গেট। ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মী পাসপোর্ট হাতে নেয়ার পরই বড় নিঃসঙ্গ মনে হলো। নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসার গভীরতা অনুভব করতে শুরু করলাম। হাত নাড়ছিলেন বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। কিন্তু এরপরও বাজে অর্ভ্যথনা। গোফ ওয়ালা ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মীর প্রশ্ন- বাংলাদেশী মুদ্রা আছে- কতো?
বাসে ফেরার জন্যে আমাদের পকেটে ১৫শ’টাকা ছিলো। দুই নিরাপত্তা কর্মী তা নিয়ে নিলো। জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমন। তাও সড়ক পথে। অজানা এক ভয় কাজ করছিলো। টাকা নেয়ার পর অবশ্য দ্রুত পাসপোর্ট এ অফিস থেকে ও অফিসে ছুটছিলো। শেষের কক্ষে পাসপোর্ট পৌছাঁনোর পর ডাক পড়লো আমার। ভেতরে ঢুকতেই নির্লজ্জের মতো ভারতীয় মুদ্রায় দুশো টাকা ঘুষ চাওয়া হলো। আমি বললাম, ভারতীয় মুদ্রা নেই। ডলার আছে। ডলারে নেন। তারা বললেন, না। ভারতীয় মুদ্রাই দিতে হবে। এভাবে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, কোথায় যাচ্ছেন?
বললাম সাগরময় ঘোষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো। তারা উৎসাহ দেখালেন না। তখনই বুদ্ধি খাটালাম। ঢাকায় তখন ঘন ঘন আসছিলেন হৈমন্তি শুক্লা। একাধিক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। হৈমন্তি শুক্লা সেলিব্রেটি। তাকে হয়তো ধরা যায় না। তবে তার স্বামীকে পাওয়া যায়। ঢাকার শেরাটন হোটেলে হৈমন্তি শুক্লার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। ভীষন অমায়িক। তখন আমাদের হাতে সব সময়ই একটা ডায়েরি থাকতো। আমি কলকাতায় হৈমন্তি শুক্লার ঠিকানা জানতে চেয়েছিলাম। হৈমন্তি শুক্লার স্বামী নিজ হাতে আমার ডায়েরিতে সে ঠিকানা লিখে দিয়েছিলাম। ভারতীয় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের শেষ বৈতরণী পেরুনোর সময় এই ডায়েরির সেই পৃষ্ঠাটি মেলে ধরলাম। বললাম হৈমন্তি দি’র বাড়িতে যাবো। এই যে ঠিকানা। আমার এ কথায় ঘুষখোর অফিসাররা খানিকটা লজ্জা পেলেন। অবস্থান্ পরিবর্তন করলেন তারা। ঘুষ আর চাইলেন না। আমি যখন নিজেই তাদের টাকা দেয়ার কথা বললাম, তখন তারা বললেন- না। থাক। এখন নয়। ফেরার সময় না হয় দেবেন। তবে মুখ বাকাঁ করে তারা এও বলতে ছাড়লেন না- দিদি তো আর এ পথ মাড়ান না। তিনি আকাশ দিয়েই যান।
সে যাই হোক, কলকাতায় পা দেয়ার পর থেকে মাথায় চিন্তা একটাই- কিভাবে সাগরময় ঘোষের কাছে যাবো। কলকাতার পার্ক স্ট্র্রিটের একটি গেষ্ট হাউজে ওঠেছিলাম। ঢাকা থেকেই দেশ পত্রিকার টেলিফোন নম্বর নম্বর নিয়ে গিয়েছিলাম। দুরু দুরু বক্ষে ফোন করলাম। অপারেটর ধরলেন। বললাম সাগর ময় ঘোষ দাদার সঙ্গে কথা বলবো, বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
একটু অপেক্ষায় রাখলেন অপারেটর। এরপরই লাইন দিলেন সাগরময় ঘোষকে। আমি শুধু অবাকই নই। রীতিমতো বাকরুদ্ধ। এতো দ্রুত পেয়ে যাবো তাকে! তিনি কথা বলতে না বলতেই এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললাম, দাদা আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তরুণ সাংবাদিক। আপনার আর্শীবাদ নিতে। আপনি কি আমাকে একটু সময় দেবেন।
তিনি বললেন, কঠিন সময়। দেশের শারদীয় সংখ্যার মেক-আপ করছি। ঠিক আছে কাল চলে আসুন। কুড়ি মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবো না।
আমি তো তাতেই খুশি। কুড়ি মিনিট? সে তো অনেক সময়।
সারারাতটা উত্তেজনায় কাটলো। স্বপ্ন দেখলাম তাকে নিয়ে। কল্পনায় আকঁতে শুরু করলাম তাকে। কেমন তার চেহারা? গম্ভীর, রাগী? যা-ই হোক, তিনি সময় দিয়েছেন সেটাই বড়।
পরদিন সকাল। ঘুম ভেঙ্গে গেলো উত্তেজনায়। মুখ হাত ধুয়ে নাশতা খেয়েই রাস্তায়। ঢাকা থেকে বারণ করে দেয়া হয়েছিলো দিনের কলকাতায় যেন কোন মতেই ট্যাক্সিতে না চড়ি। কিন্ত স্বপ্নের ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করবো। ঝামেলায় জড়াতে চাইলাম না। ট্যাক্সি নিলাম। ৬ প্রফুল্ল চন্দ্র স্ট্রিট, আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসের সামনেই থামলো। গেটে অর্ভ্যর্থনা কর্মীর হালকা জিজ্ঞাসাবাদের পরই সিড়ি দেখিয়ে দিলো। ঢাকায় বসে আনন্দবাজার হাউজের কত পত্রিকাই না পড়ি। কিভাবে সেগুলো বের হয়, দেশ-এর অফিসে ঢুকতে ঢুকতে এর আশে পাশের অফিসেও নজর গেলো। সংবাদকর্মীদের ছুটোছুটিও দেখলাম। বিশালদেহী সাগরময় ঘোষ। খুবই গম্ভীর। যেতে না যেতেই চেয়ারে বসার আমন্ত্রন। শ্রদ্ধায় গদ গদ আমি তো বসতেই চাইছিলাম। পায়ের ধুলো নিলাম তার। তিনি আমাকে বুকে টেনে নিলেন। আমি তখনও নার্ভাস। কি দিয়ে শুরু করবো। বলেই ফেললাম, স্রেফ আর্শীবাদ নিতে এসেছি। আমার স্পর্শে অনেক লেখক তৈরি হয়েছে। আমি আপনার পৈত্রিক দেশের বাসিন্দা। আমাকেও আশীর্বাদ করুন।
গর্বে বুক ভরে গেলো চার দিকে তাকাতেই। সাগরময় ঘোষের মাথার ওপর পাশের দেয়ালে ঝুলছিলো কামরুল হাসানের একটি ড্রয়িং। নোম্যান্স লেন্ড অতিক্রম করার পর ভারতীয় ভূখন্ডে পা দিয়ে যে নিঃসঙ্গতা অনুভব করেছিলাম, এই একটি ছবির গর্বে মুহূর্তেই যেন আমি সাহসী হয়ে ওঠলাম। নিজের কিছু লেখা নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলোর ক্লিপিং তার টেবিলে মেলে ধরলাম। তিনি চোখ বুলালেন। অনুমতি চাইলাম পত্রিকার জন্যে ছোট খাটো একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই। রাজি হলেন তিনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আদি অন্ত তিনি বললেন। জানালেন আবুল বাশারকে খুজে বের করার কাহিনী। একজন মুসলমান ঔপন্যাসিক খুজেঁ বের করার অদম্য ইচ্ছা ছিলো তার। আবুল বাশার এর পূর্ণতা এনে দিয়েছেন। তার একটি কথা আমার কানে সব সময়ই বাজে। আমি মনে করি আমাকে দেয়া সাগরময় ঘোষের দীক্ষা। তা হলো- নেগেটিভ সাংবাদিকতার কোন স্থায়ীত্ব নেই। কখনও কেউ যখন আমাকে নেগেটিভ সাংবাদিকতায় উসকে দেয়, তখন সাগরময় ঘোষের গম্ভীর উচ্চারণ আমার হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়। সাগরময় ঘোষ আরও বলেছিলেন, কর্পোরেট হাউজগুলো তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করার জন্যেই সংবাদপত্র প্রকাশ করে। আর স্বার্থ সিদ্ধি করতে গিয়ে একটা পর্যায়ে তারা নেগেটিভ সাংবাদিকতা শুরু করে। আর তখনই তারা হারিয়ে যেতে শুরু করে। সংবাদপত্রও একটা বানিজ্য। তাই বলে সেটি মুখ্য নয়। লেখক সৃষ্টি করা, সৃজনশীল প্রতিভা খুজে বের করাও সংবাদপত্রের কাজ। সাগরময় ঘোষ দেশ পত্রিকাকে সে কাজেই ব্যবহার করেছেন। সে কারণেই এটি আলাদা।
সময় দিয়েছিলেন তিনি কুড়ি মিনিট। কিন্তু আলাপ চারিতায় এ সময় পেরিয়ে গেলো। হঠাৎই তার দৃষ্টি গেলো টেবিলে রাখা ডামি শিটগুলোর দিকে। হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। শ্রদ্ধাবনত হয়ে আমি ফিরলাম। আনন্দবাজার পত্রিকা ভবন ছেড়ে রাস্তায় নামতে নিজেকে অসম্ভব সাহসী মনে হলো। বিদেশের মাটিতে প্রথম সাক্ষাৎকার নিলাম এক স্বপ্ন গুরুর। আমার স্পর্ধা বেড়ে গেছে। সতীর্থ আলোকচিত্রী ফরিদ বাশারকে নিয়ে নেমে পড়লাম কলকাতার রাস্তায়। একটা সচিত্র সিরিজ রিপোর্ট করে ফেলবো।
কলকাতার দেশ পত্রিকার সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিলো ৫০ বছরের। ১৯৩৯ সালে যোগ দিয়েছিলেন তিনি সহকারি সম্পাদক হিসেবে। দিনে দিনে পূর্ণতায় তিনি ১৯৭৬ এ দেশ সম্পাদক হন। সাহিত্য নির্ভর এ ম্যাগাজিনটি অবশ্য আপত্তি কর নিবন্ধ লেখায় বাংলাদেশে এক সময় নিষিদ্ধ হয়েছিলো। সাগরময় ঘোষ আর পৃথিবীতে নেই। ১৯৯৯-এর ১৯ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেছেন তিনি ৮৬ বছর বয়েসে । কিন্তু তার প্রতিভা অšে¦ষণে বের হওয়া প্রতিভাধররাই আজ বড় লেখক। ঔপ্যানাসিক। দেশ পত্রিকাকে তিনি লেখক তৈরির প্লাটফরম হিসেবে তৈরি করেছিলেন। তার হাতে তৈরি হওয়া লেখকদের অনেকেই আজ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। পশ্চিম বাংলা ছাপিয়ে এদেশেও অনেকের প্রবল জনপ্রিয়তা। এদেশের ঈদের বিশেষ সংখ্যায় সেই সব লেখকদের লেখা ছাড়া চলেই না। কিন্তু এ প্রজন্ম সাগরময় ঘোষকে কতটা চেনে? ইন্টারনেটে তাকে নিয়ে লেখা তথ্য যৎসামান্যই। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট থেকে ঢাকার আজিজ মার্কেট- সাগরময় ঘোষকে নিয়ে লেখা বইয়ের সন্ধান করা হলো অনেক। হতাশই হতে হলো। কোন সংবাদ নেই। চাঁদপুরে ছিলো তার পৈত্রিক ভিটা। খোজঁ নেয়া হলো সেখানে। নদী ভাঙনে হারিয়ে গেছে সাগরময় ঘোষের স্মৃতি। তার সম্পর্কে জানেন অনেকেই। কিন্তু সবার জানার সে সুযোগ নেই। মানুষের জীবনটাই বোধ হয় এরকম। আস্তে আস্তে সবকিছুই যেন হারিয়ে যায় স্মৃতির অতলে। কিন্তু এলবামে থাকা সাগরময় ঘোষের সঙ্গে ৮৯-এর সেই ছবিগুলো এখনও আমার কাছে জীবন্তই মনে হয়। তার আর্শীবাদ নেয়ার ঘটনাটির কথা মনে হলে কলকাতা সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা জীবন্ত ছবির মতোই হৃদয় পটে ভেসে ওঠে।
একটি মিডডে’র স্বপ্ন
- কোন এক বিকালে হঠাৎই এসেছিল ফোনটা। অপরপ্রান্তে দৈনিক ভোরের কাগজের প্রকাশক সাবের হোসেন চৌধুরী। যিনি ইন্টারপার্লামেন্টারি ...
স্বপ্নের ই-মেইল, আবেগ এবং...
- সুইডেনের ছোট্ট একটি শহর কালমার। বাল্টিক সাগরের তীরে ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন এ শহর। মানুষ নেই খুব একটা। ...
এখনো মনে হয় সেই দিনের ঘটনা
- এখনো মনে হয় সেই দিনের ঘটনা। আহ্ কী উত্তেজনাই না ছিলো আমাদের ভেতর। নতুন কিছু করা ...