বেঁচে থাকার অধিকার, চাওয়াটা কি খুব বেশি?
ঘটনা মাত্র ৫ থেকে ৭ মিনিটের। কিন্ত্ত এই সময়টাকেই মনে হলো যেন অনেক দীর্ঘ। প্রাণের ভয়। দিগ্বিদিক ছুটোছুটি নারী পুরুষের। হঠাৎ ছুটতে গিয়ে আহতও হলেন কেউ কেউ। ককটেল আর পেট্রোল বোমার বিভীষিকা! তারুণ্যের সুচনালগ্নেই- এরশাদ বিরোধী গণআন্দোলনে উত্তাল রাজপথ দেখেছি। এরপর থেকে সহিংস রাজনীতি দেখার অভিজ্ঞতা কম নয়। বরং এ অভিজ্ঞতা বাড়ছে প্রতিদিনই । অথচ, সেই আমিও হঠাৎ ঝাঁকুনি খেলাম প্রচন্ড। বয়েস বেড়ে যাচ্ছে বলেই কি? নাকি স্ত্রী আর পরিবার, প্রজন্মের ভবিষ্যতের চিন্তায়? যানবাহনের ভিড়ে অনেকটাই স্বাভাবিক মনে হওয়া রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম ব্যক্তিগত কাজে। পাশে স্ত্রী। মালিবাগ চৌধুরী পাড়া- মৌচাক রাস্তায় বিরতি ক’মিনিটের জন্যে । তখনই হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ । গাড়ির কাছাকাছি বিকট শব্দ আরেকবার। এরপরই দেখলাম, মানুষের দৌঁড়। দোকান পাটের শাটার নামছে। ফ্লাইওভারের পিলার নির্মাণের জন্যে সুউচ্চ যে ক্র্যানগুলো ছিলো, সেগুলো দ্রুত পালাচ্ছে উল্টো দিকের রাস্তা দিয়ে। বিস্ফোরণের শব্দ বাড়ছেই । একদিকে নয়। একটা কাছে তো। আরেকটা দুরে।এবার রাস্তায় হাজির ককটেলবাজরা । দুর থেকেই দেখা গেলো, ওরা বয়েসে তরুণ। ওদের হাতে ব্যানারও ছিলো। কিন্ত্ত মুখে কোনো স্লোগান নেই। তরুণরা যুদ্ধংদেহী। একেকজন একেক দিকে ছুটছে, বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। আর প্রাণভয়ে সবাই দৌঁড়াচ্ছেন এদিক সেদিক। মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে গেলো পুরো রাস্তা। আকস্মিকতায় হতভম্ব আমি এবং আমার ড্রাইভার। ভয়ে আচ্ছন্ন আমার স্ত্রী। একবার শুনলাম সে বলছে, গাড়ি ঘুরাও। আবার বলছে- নামো। একপর্যায়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে নামালো সে। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো পাশের বহুতল এক ভবনের গ্যারেজে। গাড়ি ফেলে রেখে পালালো আমার ড্রাইভারও। গ্যারেজের ভেতর আশ্রয় নিয়েছেন আরও অনেকে। ভয়ে কাপছেন তারা। দোয়া দরুদ পড়ছেন। ককটেল বিস্ফোরণ তখনও চলছে। গ্যারেজের পাশেই বিস্ফোরিত হলো একটা। দরজার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, পুরো রাস্তায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে একমাত্র আমার গাড়িটিই। একজনকে দেখলাম ইট হাতে ছুটে আসছে সেদিকেই। আমার স্ত্রী চিৎকার করছে, আমাদের গাড়িটাতে আগুন দিবে…। আমি নির্বাক । অসহায় । কিইবা করার আছে। রাস্তার ওপাশে দেখা গেলো আগুন জ্বলছে। ঠিক তখনই সাইরেনের শব্দ। ককটেল ফাটাতে ফাটাতে গলির ভেতর ঢুকে গেলো তরুণরা। ঘটনাস্থলে হাজির হলো পুলিশের একটি ভ্যান। গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ সদস্যরা আগুন নেভালেন। আরও ক’মিনিট রাস্তা থাকলো জনশূন্যই। এরপর উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করে মানুষ। দুর থেকে এসে আমার ড্রাইভারও গাড়িতে স্টার্ট দেয়। আমার স্ত্রী বললো, চলো বাড়ি ফিরে যাই। দরকার নেই আর রাস্তায় থাকার। তাতে সায় দিলো ড্রাইভার, প্রচন্ড ভয় পেয়েছে সেও। আমি সাহস দেখাতে পারলাম না। কিভাবে দেখাই বলুন, আগে তো দেখতাম রাজনৈতিক স্লোগান দিয়ে রাস্তায় জঙ্গি মিছিল করতে । আর ওই সব মিছিল রাস্তা অতিক্রমের সময় আশপাশের মানুষ কখনও কখনও সমর্থন যোগাতো হাততালি দিয়ে। ককটেলবাজদের তৎপরতায় এটা স্পস্ট হলো, তারা টার্গেট করেই ভীতি ছড়াচ্ছে। আর কৌশলটাও ভয়ঙ্কর। এক সঙ্গে তারা আসে না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিশে থাকে সাধারণ মানুষের সাথে। সঙ্কেত দিয়েই সবাই ককটেল ছুড়ে মারে চারদিক থেকে।যেন ককটেল ফাদেঁ আটকে ফেলতে চায় রাস্তায় চলা মানুষগুলোকে। এ ধারা যদি বাড়তে থাকে ভাবুন তো, কি হবে পরিণতি?
সরকারের পতন ঘটানোর দাবিতে রাজনৈতিক কর্মসূচী নতুন নয় এদেশে। দাবি আদায়ের জন্যে আন্দোলন হচ্ছে হরহামেশাই। আন্দোলনকারীরা সব সময়ই তাদের পেছনে জনসমর্থন বাড়াতে উদ্যোগী হয় । আর জনসমর্থনের গতিময়তার কাছেই পরাস্ত হয় ক্ষমতাশালীরা। কিন্ত্তু এভাবে ভয় দেখিয়ে কি তা সম্ভব? আজ একজন ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটাবেন অবিবেচকের মতো। কাল আরেকজন অনুসরণ করবেন দেখিয়ে দেয়া এ পথ। আমরা সাধারণ জনগণ আপনাদের এই কীর্তিতে ভীতু হয়ে শুধুই কি দৌঁড়াবো? রাজনীতিবিদদের হয়তো কাজে যেতে হয় না ।দিব্যি তাদের সংসার চলে । বিত্ত, বৈভবেরও কমতি নেই। নিশ্চিত করেই বলা যায়, বাসায় বসে থেকে সংসার চালাতে পারলে অসহনীয় এই সময়ে অনেকেই বাইরে বের হতেন না। কিন্ত্ত যারা উপায়হীন, তাদের কেনো নিশানা করবেন? দোহাই, দেশটাকে ককটেলময় করবেন না । সরকারের সঙ্গে লড়াই করুন। কিন্ত্ত নিরপরাধ মানুষকে বলির পাঠা বানাবেন না। যারা সরাসরি রাজনীতি করেন- কেবল তাদের জন্যেই দেশটা নয় । রাজনীতি না করার অধিকারও মানুষের আছে। শান্তিপ্রিয় সেই মানুষগুলো তো শুধু বেঁচে থাকার অধিকারই চান। সেটি কি খুব বেশি চাওয়া?