বৃদ্ধ নিবাসেই তাঁরা স্বাধীন
পরিবার পরিজন আছেন কাছাকাছি। আছে নিকটাত্মীয়ও। তবুও বৃদ্ধ নিবাসেই ঈদ করবেন ইয়াতুন্নেছা ও শাহানা বেগম। ইয়াতুন্নেছার বয়স ৭০। মাথার অধিকাংশ চুল সাদা। চোখে পুরো লেন্সের চশমা। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। ঢাকার অভিজাত এলাকায় তার সব আত্মীয় স্বজন। বাড়ি, গাড়ি আছে। ইয়াতুন্নেছা বললেন, বৃদ্ধ নিবাসই আমার পরম শান্তি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই থাকতে চাই। ঈদ করবো এখানেই। ৫০ বছর বয়স শাহানা বেগমের। অর্ধেক শরীর অবশ। ঢাকায় ২ ছেলে ও ১ মেয়ে আছেন। তিনজনই কম্পিউটার নিয়ে পড়াশুনা করছেন। কাজ করছেনৱ। নিকটাত্মীয়দের বাড়িঘরও আছে। ফাতেম বেগম বললেন, ঈদ করবো এ নিবাসেই। এটাই আমার বাড়িঘর- সবকিছু। পরিবার পরিজনের সাথে ঈদ করার জন্যে একদিকে মানুষ গ্রামমুখী। ঢাকা ফাঁকা। অন্যদিকে বিপরীত চিত্র রাজধানীর পশ্চিম প্রান্তের শ্যামলীতে।
মোহাম্মদপুর পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটির ১নং রোডের ৩৮ নম্বর বাড়িতেই মরহুম মাহাবুবা খাতুন প্রতিষ্ঠা করেন এ বৃদ্ধ নিবাস। মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মাহাবুবা খাতুন বাংলাদেম গার্লস গাইডের পাবলিসিটি কমিশনার ছিলেন। এ নিবাসের নাম রেখেছেন তিনি ঝরা পাতা। উদ্দেশ্য আলাদা। শারীরিক কিংবা অর্থনৈতিকভাবে দুস্থদের জন্যে এ নিবাস নয়। মানসিক কষ্ট আছে, এমন বৃদ্ধদেরই আশ্রয়স্থল এই ঝরা পাতা। সমাজকল্যাণ বিভাগ অবশ্য এর রেজিষ্ট্রেশন করেছে বৃদ্ধ নিবাস হিসেবে। উচ্চবিত্তদের সমস্যা নিজেরাই মোকাবিলা করতে পারে। নিম্নবিত্তরা প্রকাশ করতে পারে অবলীলায়। মধ্যবিত্তরা না পারে প্রকাশ করতে, না পারে সহ্য করতে। মাহাবুবা খাতুনের টার্গেট এই শ্রেনী। সময়ের পরিবর্তনে মধ্যবিত্ত পরিবারে বৃদ্ধদের অসহায়ত্ব অনেক বেশি। চাকরির জন্যে সন্তান শহরে। বৃদ্ধ মা কিংবা বাবা পড়ে আছেন নির্জন গ্রামে। অথবা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছেন সন্তান। একাকীত্বের যন্ত্রণায় বৃদ্ধ মা অথবা বাবা। তবে বৃদ্ধ বয়েসে মায়েদের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের অসহায়ত্ব্ অনেক বেড়ে যায়। মেয়ের সাথে তারা থাকতে চান না।কখনও কখনও ছেলের সংসারে তারা নিজেদের অপাঙক্তেয় ভাবতে শুরু করেন। তখনই সৃষ্টি হয় হতাশার। বৃদ্ধ বয়েসে আশ্রয়স্থল হয়ে পড়ে বড় প্রশ্ন। এই হতাশ শ্রেনীর কথাই ভেবেছেন মাহাবুবা খাতুন। তারই মেয়ে মুসিয়া মাহফুজা বললেন, মা এর নাম দিয়েছিলেন সুখের নীড়। কিন্ত্ত প্রতিরাতেই ফোন আসতো। অশ্লীল প্রশ্ন করা হতো- এখানে কি কি সুখ পাওয়া যায়। তাই নাম পরিবর্তন হয়। শ্যামলীতে বৃদ্ধ নিবাস হিসেবেই এটি পরিচিতি পেয়েছে। বিচারপতি মোস্তফা কামাল এর উদ্বোধন করেছিলেন। বর্তমানে এখানে ২জন নারী এবং ২জন পুরুষ থাকছেন। এ পযর্ন্ত সাতজন নারী এ নিবাসে থেকেছেন। থেকেছেন ৬জন পুরুষ। নিবাসে থেকেই একজনের মৃত্যু হয়েছে। ইয়াতুন্নেছা ’৯৬ সাল থেকে আছেন। তার স্বামী জিল্লুর রহমান ছিলেন পোস্টাল বিভাগের প্রধান। মারা গেছেন। ভাই আবু মো: ফয়সাল কাদের বাংলাদেশী মিশনে গুরত্বপুর্ণ দায়িত্ব্ পালন করেছেন। তিনিও প্রয়াত হয়েছেন সম্প্রতি। তার সব ছেলে মেয়েই প্রতিষ্ঠিত। বনানী, লালমাটিয়াতে আছেন। ইয়াতুন্নেছা কোথাও যেতে রাজি নন। বললেন, জীবনের এক পর্যায়ে স্বাধীনতা প্রয়োজন। বৃদ্ধ নিবাসে সে স্বাধীনতা আছে। এখানে কোনো কড়াকড়ি নেই। তিরষ্কার নেই। চোখ রাঙানির ভয় নেই। নিজের যা ইচ্ছে তাই করা যায়। নি:সন্তান ইয়াতুন্নেছা স্বীকার করলেন না তার জীবনে কোথাও এ স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। ভাই তার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। ভাই-বোনের মেয়ে, তাদের জামাইরাও খোঁজ খবর নেন। তবুও স্বাধীনতার জন্যে এ নিবাসে আছি। নিবাস কর্তৃপক্ষ জানালেন, ইয়াতুন্নেছা সারাদিন হাটেঁন।কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ান। ভালো কেক বানাতে পারেন। রান্না করতে পারেন কাবাব। ঘুরে ঘুরে এর উপকরণ তৈরি করেন। ইয়াতুন্নেছা বললেন, আমি নিজের মতো থাকতে চাই। স্বাধীনতার আনন্দ আলাদা। এখানে সম্মান থাকে। সম্মান ছাড়া জীবনে আর কি আছে। বৃদ্ধ নিবাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইয়াতুন্নেছা লিখিতভাবে তাদের জানিয়েছেন, তার মৃত্যুর পর নিবাস কর্তৃপক্ষই যেন লাশ দাফন করে। আত্মীয়স্বজনদের হাতে যেন না দেয়া হয়। ইয়াতুন্নেছার বক্তব্যে কি কোনো ক্ষোভ লুকায়িত আছে? এ প্রশ্নের তিনি জবাব দেননি। বলেছেন, এটাই আমার স্বাধীনতা। শাহানা খাতুনের বাড়ি দিনাজপুর শহরে। ২ কন্যা ১ পুত্রের জননী। স্বামী আব্দুল মোতালেব একজন ঠিকাদার ছিলেন। ছবির মতো সাজানো ছিলো সংসার। স্বামীর মৃত্যুর পর এলোমেলো হয়ে হয়ে গেছে সব। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছেলে ছোট। ছেলে ছোট, ইন্টারমিডিয়েট পাস করে কম্পিউটার ফার্মে কাজ করছে। থাকছে মেসে। মেয়ের বাড়িতে থাকতে পারেন না মা ।তাই সবাই মিলে বৃদ্ধ নিবাসেই নিয়ে এসেছেন। শরীর অবশ বলে আকেজন মেয়ে রেখে দেয়া হয়েছিল প্রথম দিকে। এখন সে নেই। তাই বড় মেয়েটাই যত্ম-আত্মি করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বড় মেয়ে বললেন, সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবেই বৃদ্ধ নিবাসে উঠেছেন। তার স্বামী বিদেশে। অসুস্থ মাকে নিয়ে একা বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়। বৃদ্ধ নিবাসে অন্তত এ নিরাপত্তা আছে।
১টি কক্ষে পাতা দু’টো লোহার খাট। তাতেই ঘুমান দু’জন। পায়ের কাছে ১৪ ইঞ্চি একটি টেলিভিশন। দেয়ালে ছোট্ট একটি আয়না। ছোট্ট একটি বারান্দা আছে। মন খারাপ হলে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তারা আকাশ দেখেন। শাহানা বেগম বলেন, বৃদ্ধ নিবাস কর্তৃপক্ষ একটা ম্যাক্সি দিয়েছেন। সেটাই পরবো ঈদে। মুসিয়া মাহফুজা জানান,’৭৫-এ তার মা এ নিবাস প্রতিষ্ঠা করলেও’৯৫ পযৃন্ত এটি একেবারেই খালি ছিল। এরপর লোক আসছে। এ বৃদ্ধ নিবাসে ভর্তি হবার নিয়ম ভিন্ন। কষ্ট নিয়েও অনেকে সংসারে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার চেষ্ঠা করেন। না পারলেই কেবল বাড়ি ছাড়েন। বৃদ্ধ বয়েসে অনেকেই ঝুঁকি নেয়ার সাহস পান না। বিশেষ করে নারীরা কষ্ট সহ্য করেন নীরবে। তিনি বেশ কিছু কাহিনী বললেন। তার ভাষায়- একবার এক বৃদ্ধ গভীররাতে চলে আসেন এখানে। প্রমিন্যান্ট হাউজিংয়ে তার ফ্ল্যাট আছে। আমাদের কাছে এসে বললেন, মা, আমি আর যাবো না। সম্ভবত পুত্র-পুত্রবধূর সাথে মনোমালিন্য হয়েছিল। ২৬ দিন তিনি এখানে ছিলেন। একদিন ডায়াবেটিক হাসপাতালে হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গেলে তার ছেলে মেয়েরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। ক’দিন আগে বনানী থেকে এক দম্পতি টেলিফোন করেছে। বলেছে, আমরা শাশুড়িকে রেখে যেতে চাই। পরে আবার ফোন করে বলেছে, না ভাই রাখবো না। সামাজিকভাবে সমস্যায় পড়ে যাবো। আরেকদিন রাতে গাড়ি নিয়ে হাজির এক নারী। বললেন, ‘ ড্রাইভারকেও বলিনি। আমি এখানে থাকবো।আমরা এখানে সবাইকে রাখিনা। বোঝানোর চেষ্ঠা করি। তিনি জানান, ইদানীং এমন ঘটনা বাড়ছে। বিশেষ করে নারীদের কেস। এ বৃদ্ধ নিবাস প্রতিষ্ঠা করে মাহাবুবা খাতুন গার্লস গাইডের পুরস্কার পেয়েছেন। মুসিয়া মাহফুজা বললেন, এ বিল্ডিংটি পুরোটাই বৃদ্ধ নিবাসের জন্যে। মা আরো জমি কিনে রেখেছেন। মা কখননোই চাননি এটি কোনো এনজিও হোক। আমরাও তা করবো না। মা মৃত্যুর আগে যে কথা বলেছেন, আমরা ২ ভাই ২ বোন তা পালন করছি। এই বৃদ্ধ নিবাসে পোস্ট অফিসের একজন কর্মকর্তা থাকতেন। এখানেই তার মৃত্যু হয়েছে। তার দুর সম্পর্কের এক ভাগিনা তাকে এখানে রেখে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার সঞ্চয়কৃত অর্থ এ নিবাসে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। মা নেন। বলেছেন, এতে তার আত্মীয়দের মাঝে ভুল ধারণা হতে পারে। এ বৃদ্ধের মৃত্যুর পর তার ট্রাঙ্ক খুলে পাই নাড়ে ৪ লাখ টাকার চেক। আমরা সেই চেক ভাগিনার কাছে পৌছেঁ দিয়েছি। মুসিয়া মাহফুজা বলেন, এ কথা সত্য, আগের চেয়ে বৃদ্ধ নিবাসে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। এর মানেটাই হলো, কষ্ট প্রকাশিত হচ্ছে। শ্যামলীর এই বৃদ্ধ নিবাসে ভর্তি ফি ১ হাজার টাকা। আর প্রতিমাসে ডোনেশন সর্বোচ্চ ৩ হাজার এবং সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা। সকল সদস্যের তিন বেলা খাবার বৃদ্ধ নিবাস কর্তৃপক্ষ ফ্রি দেন। শাহানা ও ইয়াতুন্নেছা বললেন, শান্তিটাই হলো আসল। সবাই চায় শান্তিমতো মরতে। বৃদ্ধ নিবাসে শান্তিতেই আছি। বাড়িতে থাকলে মনে হয় যেন অন্যকে কষ্ট দিচ্ছি। অন্যের সাহায্য নিয়ে এখানে থাকলেও মনে হয়, এ আমারই বাড়ি-ঘর। আমি সব কিছুই করতে পারি। কোনো শাসনের বেড়াজাল নেই।
২৬ ডিসেম্বর, ২০০০-এ দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত।
নাইরোবির এক ট্যাক্সি ড্রাইভার
- ১৯৯৪ সালে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবীতে আইসিসি ট্রফি কভার করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল এক ট্যাকিস্স ড্রাইভারের সঙ্গে.......
এত গোল ফুটবলে হয় না...
- ওল্ডরিখ সোয়ার সুইজারল্যান্ডের কোচ। ঢাকায় এসেছিলেন সাফ গেমসের জন্যে বাংলাদেশকে তৈরি করতে। বাংলাবাজার পত্রিকায় ১৯৯৩ সালের ...
ডলফিন ফ্লাই এবং ঘুম বিসর্জন
- কোন জাতি সবচেয়ে বেশি অলস? এমন প্রশ্নে নানা বিতর্ক হতে পারে৷ সামনে আসতে পারে বিভিন্ন উদাহরণ ...
Slow Death from Arsenic
- THE appalling scenario of the country has been reflected in a recent survey, which says that ...