‘মৃত’ শিশুটি ১৩ ঘন্টা...
শিশুটিকে ‘মৃত’ ঘোষণা করে ফেলে দেয়া হয়েছিলো বারান্দায় খোলা আকাশের নীচে। বৃষ্টির পানি পড়েছে তার গায়ে। ‘মৃত’ শিশুটি জীবনের ঘোষণা দিয়েছিল। ১৩টি ঘন্টা বেঁচে ছিলো। কিন্ত্ত সভ্যতা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলো তার থেকে। কেউ তাকে বাঁচাতে আন্তরিকভাবে এগিয়ে এলো না। না চিকিৎসক, না ঢাকার কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অনাদর আর চরম অবহেলার শিকার হলো শিশুটি। গতকাল ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই সে চলে গেছে পরপারে। স্থান মগবাজার চৌরাস্তা সংলগ্ন আদদ্বীন হাসপাতাল। শিশুটির মা শাহিদা আক্তার রীনা একজন কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকা। বাবা ওহিদুল হায়দার একজন ব্যবসায়ী। বাড়ি ৩১৬/৮ দক্ষিণ গোড়ানে। রীনা ছিলেন ৭ মাসের অন্ত:সত্ত্বা। ক’দিন ধরেই তার স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিলো না। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিলো। একবার ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছিলো্ তাকে। একদিনেই নিরাময়। বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন তিনি।মঙ্গলবার ব্যথা বেড়ে যায়। আবার ফিরে আসেন ক্লিনিকে। গাইনি চিকিৎসক গুলশান আরা ব্যথা উঠিয়ে বাচ্চা প্রসব করান। জানান,মৃত সন্তান অপসারন করা হয়েছে। পলিথিনের ব্যাগে পুরে শিশুটিকে ফেলে রাখা হয় বারান্দায়। আষাঢ়ের প্রবল ঢলে ‘মৃত’ ঘোষিত শিশুটি পড়ে থাকে। তার বাবা ছুটেন বাড়িতে। দাফন করতে হবে। কাফনের কাপড় কিনেন। শিশুর জানাজা হবে কী না জানতে চান।শেষ বিকেলে বাবা ছুটে আসেন ক্লিনিকে। চিকিৎসককে অনুরোধ করেন একটা ডেথ সার্টিফিকেট দিন। তক্ষুনি হাসপাতালের এক রোগী চিৎকার করে ওঠেন- বাচ্চাটি তো নড়ছে। ঘণ্টা তিনেক আগেও তিনি একবার চেঁচিয়েছিলেন। তখন নার্সরা বলেছেন, মৃত সন্তান হলেও নড়াচড়া করে মাংসপেশীর কারণে। ডেথ সার্টিফিকেট দেবার আগে চিকিৎসকের মন একটু নরম হলো- দেখি তো কি অবস্থা! পলিথিনের ব্যাগটি তুলে আনতেই সবার চোখ ছানাবড়া হয়- আরে এতো জীবন্ত শিশ! তার শ্বাস- প্রশ্বাস চলছে। কাফনের কাপড় হাত থেকে পড়ে যায় বাবার। আর্তনাদ করে উঠেন তিনি- জীবন্ত এ শিশুটিকে ৩ ঘন্টা কেন ফেলে রাখা হলো বারান্দায়, বৃষ্টির মধ্যে। ওকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিন- ভিড় জমে যায় রোগীদের। তাদের মধ্যে অন্ত:সত্ত্বা অনেকে। অবহেলার ধরণ দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তারা।গাইনি চিকিৎসক কেটে পড়েন দ্রুত। সিস্টাররা পরামর্শ দেন- একে বাঁচাতে হলে ভালো হাসপাতালে নিয়ে যান। আবারো দৌড় ঝাঁপ। কোথায় অ্যাম্বুলেন্স। ক্লিনিকটির একটি অ্যাম্বুলেন্স, একটি পরিচালকের গাড়ি। ড্রাইভার একজন। পরিচালককে নিয়ে বাইরে গেছেন ড্রাইভার। অ্যাম্বুলেন্সের চাকা ঘুরবে না। চারদিকে শুরু হলো ফোন, আত্মীয় স্বজন, হাসপাতাল। একটি ড়াড়ির জন্যে হাহাকার। অফিসফেরা মানুষের ভিড় ঠেলে কোনো রকমে পৌছলো উদয়ন পলি ক্লিনিকের একটি মাইক্রোবাস। কিন্ত্ত সেখানে নেই অক্সিজেন। আদদ্বীনেও একটি মাত্র অক্সিজেন সিলিন্ডার। চরম আপত্তি নার্সদের( কারণ কর্তব্যরত কোনো চিকিৎসক নেই)। অনুনয়-বিনয়- পি।রজ! অক্সিজেন সিলিন্ডারটি ধার দিন। নইলে মেরে ফেলুন শিশুটিকে। এবার অক্সিজেন পাওয়া যায়। অ্যাম্বুলেন্স ছুটে শেরে বাংলা নগর শিশু হাসপাতালে। কর্তব্য ডাক্তার আসনে বসেই জানিয়ে দেন- সম্ভব নয় শিশুটিকে ভর্তি করা। সিট নেই। ইনকুবেটর লাগবে। সব ভর্তি। খালি নেই। শিশু হাসপাতালেও কি বাঁচানোর সুযোগ নেই? চোখ লাল ডাক্তারের- আমি কি বসে আছি। সরকারকে জিজ্ঞাসা করুন। প্রতিদিন এমন কতো রোগী ফেরত যায়। আমরা তো আর ইনুকুবেটর বানাতে পারবো না। শিশু হাসপাতালের দরজা থেকে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে বারডেমে। জরুরি বিবাগের প্রবেশ পথেই বাধা- প্রতিদিন ৩ হাজার টাকা করে ৭ দিনের অগ্রিম দিতে হবে। আপত্তি নেই। সিট?
দু:খিত। বিনয়ী কন্ঠ কর্তব্যরত চিকিৎসকের। পরামর্শ- পিজিতে যান। বারডেমের উল্টো দিকেই পিজি হাসপাতাল। জরুরি বিভাগে যেতেই টিকিট ধরিয়ে দেয়া হয়- সি ব্লকে যান শিশু বিভাগে। ত্রস্ত পায়ে ছুটোছুটি। অন্ধকারাচ্ছন্ন শিশু ওয়ার্ড। নার্স এসে বলেন, ইনকুবেটর আছে। অক্সিজেন নেই। কোথাও থেকে ম্যানেজ করুন না। আকুতি আবার। ঘন্টাখানেক ছুটোছুটি নার্সের। সেই অভিন্ন সংলা- সরি। পিজি মাড়িয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে ঢাকা মেডিকেলকলেজ হাসপাতালে। গভীর রাত। জরুরি বিভাগ লোকে লোকারণ্য। এই মাত্র পায়ে গুলি খাওয়া একজনকে আনা হয়েছে।দুর্ঘটনায় মাথা মাথা ফাটা রোগী নিয়ে পেছনে স্কুটারের লাইন। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আশ্বাস দেন- ভর্তি করে নিলাম। রোগীকে নিয়ে যান ১২ নং ওয়ার্ডে।
অ্যাম্বুলেন্স থেকে তুলোয় মোড়ানো ক্ষুদে শিশু, মাথার ওপর অক্সিজেনের বড় সিলিন্ডার। কর্কশ শব্দে এগিয়ে চলে ট্রলি। দোতলায় ১২ নং ওয়ার্ডে যেতে কর্তব্যরত ডাক্তার বলেন, শিশুটিকে কি বাঁচাতে চান? তাহলে এখান থেকে নিয়ে যান। কাল (বুধবার) এফসিপিএস পরীক্ষা। কোনো রোগী ভর্তি করতে নিষেধ করা আছে। এরপরও ভর্তি করতাম। জায়গা কই। আবার ট্রলির চাকার কর্কশ শব্দ। আবার অ্যাম্বুলেন্সে শিশুটি, নাকে তার অক্সিজেন। এবার অ্যাম্বুলেন্স থামে হলিফ্যামিলি হাসপাতালে। ইস! আর কিছুক্ষণ আগে এলে একটা সিট দেয়া যেতো। খালি নেই ইনকুবেটর। অ্যম্বেলেন্স ছোটে গুলশানের মা ও শিশু ক্লিনিকে। কর্তব্যরত ডাক্তার নুরুল ইসলাম বলেন, এখান তো কোনো ইনকুবেটর নেই। ঠিক আছে, দেখি কি করা যায়। এই প্রথম কোনো চিকিৎসককে দেখা গেলো একটি জীবন বাঁচানোর চেষ্ঠা করতে। টেলিফোন নির্দেশিকা দেখে একের পর এক ক্লিনিকে ফোন করতে শুরু করলেন তিনি। হতাশ প্রতিবারই। কারো ইনকুবেটর খালি নেই। তিনি বললেন, কাঁচা শিশু বাঁচানো এমনিতেই কঠিন। বেঁচে থাকলেও সমস্যা থাকবে অনেক। কিন্ত্ত যে বেঁচে আছে তাকে যতক্ষন পারা যায় বাঁচিয়ে তো রাখতে হবে।
বুধবার সন্ধ্যার পর অ্যাম্বুলেন্স নেমেছিলো রাস্তায়।তখন রাত দেড়টা। কোথায় যাবে শিশুটি? কান্না চেপে অভিভাবকরা শিশুটিকে নিয়ে আসেন মগবাজারের সেই ক্লিনিকে। একজন নার্স পরামর্শ দেন, দোতলায় নিয়ে যান শিশু ওয়ার্ডে। সেখানে কেনো চিকিৎসক নেই। আছেন দু’জন মাত্র নার্স। টেলিফোন আছে, বাইরে করা যাবে না। কর্তৃপক্ষ কাউকে বিশ্বাস করে না, তাই রাতে টেলিফোন শুধু ‘ইনকামিং’। নার্সরা সদয় হোন। একটি বেডের ওপর তাপ দেবার যন্ত্র। তার নিচেই একজন কোলে করে শিশুটিকে নিয়ে বসেন। ইনকুবেটর ছাড়া বাঁচবে না শিশুটি। তবুও চেষ্ঠা করা যাক। তাপের মধ্যেই এক পর্যায়ে চোখ খোলে শিশুটি। দেখতে চায় বাইরের আলো। ভোর পর্যন্ত এমনই ছিলো। হঠাৎ করেই নিভে যায় তার চোখ। বন্ধ হয়ে যায় শ্বাস-প্রশ্বাস। সে আর নেই।হাঁফ ছেড়ে বাচেঁ যেন সবাই। আর কষ্ট করতে হবে না। ছুটতে হবে না হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। বেঁচে থাকার কষ্টের চেয়ে মরণের যন্ত্রণা অনেক কম। শাহজাহানপুর কবরস্থানে কাল দাফন করা হয়েছে শিশুটিকে। একটি জীবন বাঁচাতে ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়েছে গোড়ানের একটি পরিবার।
# ১৯৯৯ সালের ৮ জুলাই দৈনিক মানবজমিন-এ লিড নিউজ হিসেবে প্রকাশিত
৩০০ বর কনে একই সময়ে...
- আর মাত্র বাকি ২৪ ঘন্টা। তারপরই বৃহস্পতিবার। ঢাকা থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরের নিভৃত গ্রাম নয়াচরে ১শ ...